প্রতীকী ছবি
নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: বন্য হাতি চলাচলের প্রায় ২১টি পয়েন্টের ওপর দিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন। রয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পও। একের পর এক বাধার কারণে হাতির জন্য এখন ‘ডেথ জোন’ হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ১৫ পয়েন্ট। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে যাতায়াতকারী প্রায় ১০০ হাতি এখন রয়েছে মহাবিপদে। নতুন পথে চলতে গিয়ে প্রাণ যাচ্ছে তাদের। গত পাঁচ দশকে তাই কমতে কমতে বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা সাড়ে ৪০০ থেকে নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। অথচ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বলছে, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় অতি গুরুত্বপূর্ণ এক প্রাণী হচ্ছে হাতি।
পাশাপাশি হাতির এই চলার পথে ভয়ংকর মাইন পুঁতেছে মিয়ানমার। পার্বত্য এলাকায় বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা ১৯৩ কিলোমিটার সীমান্তে এ মাইন পুঁতেছে দেশটি। এতদিন বাংলাদেশ অংশ তাদের জন্য নিরাপদ থাকলেও এখন নতুন ‘আপদ’ হাজির হয়েছে সেখানেও। রোহিঙ্গাদের জন্য ক্যাম্প বানাতে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের আট হাজার একর বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। এখানে ছিল হাতির চলার পথ। হাঁটার জন্য দীর্ঘ পথ লাগে হাতির। একটি হাতি হাঁটা শুরু করলে টানা ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত হাঁটতে পারে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে হাতির দল এখন খুঁজছে নতুন পথ। এসব হাতি চলার পথ খোজে নাপেয়ে রাতের অন্ধকারে ডুকে পরেছে লোকালয়ে। এসময় মানুষের হামলার হামলার শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে অসংখ্য হাতি।
আনোয়ারা উপজেলার মহাদেবপুর হয়ে বরুমছড়ার পাশ দিয়ে বাঁশখালীতে নতুন করিডোরে হাঁটছে চুনতির কিছু হাতি। আরেকটি অংশ পুরানগড়-দোহাজারীর লালুতিয়া-গড়দুয়ারা হয়ে আসছে বোয়ালখালীর পাহাড়ে। নতুন এসব রুটে চলতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বিপদে পড়ছে হাতির দল। চলতি মাসেই বোয়ালখালীতে প্রাণ হারিয়েছে একটি হাতি। একই সময় আরেকটি হাতি মারা গেছে কক্সবাজারে।
আইইউসিএনের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ রাকিবুল আমীন চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন গড়ে উঠছে হাতির চলার পথে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে চলাচল করা হাতিরা তাই বড় বিপদে রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণেও বাধাগ্রস্ত হয়েছে হাতির চলাচল। এ জন্য নতুন করিডোর ধরে হাঁটছে হাতির দল। এখন নতুন পথে গিয়ে বিপদ বাড়ছে। লোকালয়ে আসা হাতিকে মেরেও ফেলছে কিছু মানুষ। বন বিভাগ এ ব্যাপারে আরও সজাগ হলে রক্ষা করা যাবে প্রকৃতির এই বন্ধুকে।
হাতি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এ এইচ এম রায়হান সরকার বলেন, মিয়ানমার কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখায় এখন আর সেদিকে যেতে পারছে না হাতির দল। আবার বাংলাদেশেও নানা কারণে নষ্ট হয়েছে হাতির চলাচলের পথ। বাধ্য হয়ে হাতিরা এখন নতুন করিডোর খুঁজছে।
যেসব করিডোরে চলাচল :
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলায়। চুনতি অভয়ারণ্যের হাতি বাংলাদেশের এ তিন জেলার পাশাপাশি চলাচল করে মিয়ানমারেও। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগে রয়েছে হাতির তিনটি করিডোর। এগুলো হচ্ছে উখিয়া-ঘুমধুম, তুলাবাগান-পাথেরছড়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ি-রাজারকুল। কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগে হাতি ব্যবহার করে পাঁচটি করিডোর। সেগুলো হচ্ছে গমারিয়াঘোনা-রাজঘাট, তুলাতুলি-বিটঘর, ঘণ্টাখালী-মেগা কচ্ছপিয়া, খাসিয়াখালী-চাইরাখালী এবং খাসিয়াখালী-মানিকপুর। চুনতি অভয়ারণ্যের চট্টগ্রাম অঞ্চলে রয়েছে হাতির চারটি করিডোর। এগুলো হচ্ছে চুনতি-সাতঘর, লালুতিয়া-গড়দুয়ারা, সুখবিলাস-কোদালা এবং নারিচ্ছা-কোদালা। এসব করিডোরে এতদিন নির্বিঘ্নে চলাচল করছিল হাতির দল। কিন্তু রেললাইন প্রকল্প হাতির এই পথে তৈরি করছে নতুন আপদ।
এদিকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৫টি পয়েন্টেই হাতি হত্যার ঘটনা ঘটছে বেশি। এগুলো হলো বাঁশাখালীর বৈলছড়ি ও অইব্যারখীল বনাঞ্চল, চকরিয়ার ফুলছড়ির রাজঘাট, দুর্গম পান্ডাছড়ি, কাইস্যার ঘোনা ও গোয়ালিয়া পালং, ঈদগড়ের ভোমরিয়াঘোনা, উখিয়া, টেকনাফের হ্নীলা, হোয়াইক্যং, লামার ফাঁসিয়াখালীর কুমারী ও ফাঁসিয়াখালী। ৫ বছরে এসব পয়েন্টেই সবচেয়ে বেশি হাতি হত্যা করা হয়েছে।
যেভাবে প্রাণ যাচ্ছে হাতির :
গত তিন বছরে অন্তত ১৮টি হাতি প্রাণ হারিয়েছে ডেথ জোনে। চলতি মাসেই কক্সবাজারে প্রাণ হারিয়েছে একটি হাতি। চলতি বছর এ নিয়ে চারটি হাতি প্রাণ হারাল কক্সবাজারে। এর আগে চকরিয়া-লামা সীমান্তের লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি খালখুইল্যা খোলার একটি পাহাড়ি ঝিরিতে বন্যহাতির মৃতদেহ পড়ে থাকার সন্ধান পায় বন বিভাগ। এ হাতিকে গুলি করার পর আবার বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়। হাতিটির শরীরজুড়ে বৈদ্যুতিক শকের চিহ্ন ছিল।
কক্সবাজার (দক্ষিণ) বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সরওয়ার আলম বলেন, হাতির চলার পথে নানারকম স্থাপনা হয়েছে। এ কারণে দলছুট হয়ে কিছু হাতি লোকালয়ে চলে আসছে। তখন না বুঝে কিছু মানুষ তাদের আক্রমণ করছে। সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে বন বিভাগ।
২১ পয়েন্টে হচ্ছে রেললাইন :
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি ক্ষতিগ্রস্ত করছে হাতির চলার পথ। চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কের ভেতর দিয়ে প্রায় ২৭ কিলোমিটার রেললাইন বসানো হচ্ছে।
হাতি গবেষক ড. রায়হান সরকার জানান, হাতির চলাচলের পথ শনাক্ত করার জন্য তিনটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসন্ত এবং শরৎকালে দুটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। গবেষণায় তিনটি বনাঞ্চলে ২১টি স্থানে হাতির আবাসস্থল পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৩টি স্থান চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে, সাতটি ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে এবং একটি মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কে। এ তিনটি সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাতি চলাচল করে ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে।
কমছে হাতির সংখ্যা :
বন বিভাগের জরিপ বলছে, স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশে বন্যহাতির সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৫০টি। কিন্তু ২০০০ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড বাংলাদেশে বন্যহাতির সংখ্যা ২৩৯টি বলে উল্লেখ করে। আবার ২০০৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) জরিপ করে দেশে ২২৭টি হাতি থাকার কথা উল্লেখ করে। তবে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ তাদের জরিপে বাংলাদেশে বর্তমানে ২৭০ থেকে ৩২০টি হাতি আছে বলে দাবি করছে।
পাঠকের মতামত: